কোষ্ঠকাঠিন্য/কোষ্ঠবদ্ধতা (Constipation)
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে আক্রান্ত ব্যক্তির দু থেকে তিন দিন পায়খানা হয় না। পায়খানা করতে গেলে কম পরিমাণে শক্ত ও শুকনো পায়খানা হয়। এতে রোগী বুঝতে পারে যে তারপায়খানা পরিষ্কার হচ্ছে না। এটি একটি খুবই সচরাচরদৃষ্ট বিকার যাতে রোগীকে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়। তার মেজাজ খিটখিটে থাকে। একজন সুস্থ ব্যক্তি সাধারণত দিনে ২০০-২৫০ গ্রাম মল ত্যাগ করে থাকে। কিন্তু মলের পরিমাণ সেই ব্যক্তির খাবার-দাবারের ওপর বেশি নির্ভর করে।
একজন সুস্থ ব্যক্তি সাধারণত এক থেকে দুবার মলত্যাগ করে। অনেকেই আবার ৩ থেকে ৪বার পায়খানা করে। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে আক্রান্ত ব্যক্তি দিনের পর দিন মলত্যাগ করে না, বহুক্ষণ বসে থেকেও পায়খানা হয় না বা খুবই কম পরিমাণে ও শক্ত মল বের হয়, যার দরুন আলস্য, নিস্তেজ ভাব, মাথা ব্যথা, কোনো কাজে মনোনিবেশ না করতে
পারা, মানসিক চাপ, খিটখিটে স্বভাব প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে।
১. প্রধানত অন্ত্রের ক্রমসঙ্কোচ (Peristalsis) কম হওয়ার দরুন কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিয়ে থাকে।
২. খাদ্য পরিবর্তন, আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া ও জল কম খাওয়া,
৩. ময়দায় তৈরি খাবার বেশি খাওয়া;
৪. গর্ভাবস্থায় সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে
৫. আন্ত্রিক উপস্থলীময়তা (Diverticulosis) ও উপদায়ী অস্ত্র লক্ষণ-সমূহ (Irritable bowel syndrome)-এ বৃহদান্ত্রের অংশ বিশেষের (Colon) বর্তুলাকার মাংসপেশিগুলি বেশি টান-টান হয়ে যায় যার দরুন মলের এগিয়ে যাওয়ার গতি কমে যায় আর কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।
৬. কোনো মানসিক বিকারে স্বতঃক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রে পরিবর্তনের ফলে।
৭. মলের বেগ বা মলত্যাগের ইচ্ছা বার বার অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখার দরুন মল শুষ্ক বা শক্ত হয়ে যায়।
৮. মলত্যাগের সংবেদনা ধীরে ধীরে কম হতে হতে একেবারে শেষ হয়ে আসে। এই কারণটির জন্য প্রধানত বাচ্ছাদের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিয়েথাকে।
৯. কোনো বড় অপারেশনের পর কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায় কারণ দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থাকা এবং মুখ দিয়ে কোনো খাবার গ্রহণ না করার ফলে মল শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়।
১০. পেটের রোগের (যেমন বমি, বৃহদান্ত্রের ক্যানসার, পাইলোরাস আউটলেট
১১. ভাঠননিগছি গায়ে অবরোধ সৃষ্টি হওয়া প্রভৃতি) দরদনও প্রায়শই কোষ্ঠকাঠিন্য হতে দেবা খা যায়।
১২. অদাদের (Anal fissure), অশ, মলাশয় প্রদাহ (Proctitis) প্রভৃতিতে মলত্যাগকালে
১৩. কষ্ট ও বেদনার দরুন রোগী মলত্যাগ করতে ভয় পায় এবং পায়খানা করতে যায় না যার।
১৪. ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। বার বার ভোলাপ জাতীয় ওষুধ সেবন ও এনিমা (Iinema) নিতে থাকার জন্যও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে দেখা যায়।
১৫. শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং আলস্যপূর্ণ জীবনযাপনের দরনও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।
১৬. মধুমেহ, পরফাইরিন সমীকরণের গোলযোগ বা পরফাইরিয়া (Porphyria), দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ প্রভৃতি কারণে এবং বৃদ্ধাবস্থায় অস্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ার দরুন কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।
১৭. জল পরিবর্তনের দরনও (ভারী জল খেলে) কোষ্ঠকাঠিন্য হতে দেখা যায়।
লক্ষণ ও উপসর্গ:-
কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ ও উপসর্গ প্রধানত তিনটি কারণের ওপর নির্ভর করে, যথা-
(১) মল জমে মলাশয় (Rectum) ও বৃহদান্ত্রের অংশ বিশেষের (Colon) প্রসারণ এতে নিম্নলিখিত লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়-
১. শবীর ভেঙ্গে পড়া,
২. খিদে না পাওয়া, মাথা ঘোরা,
৩. মাথা ভারী মনে হওয়া,
৪. বমি-বমি ভাব;
৫. টক ঢেকুর ওঠা;
৬. মলদ্বার দিয়ে গ্যাস বের হওয়া,
৭. কোনো কাজে মন না লাগা,
৮. জিভ ফাটা ফাটা বা সাদা হওয়া,
৯. পেটে ভার বোধ, সব সময় মানসিক চাপ থাকা।
(২) বেশি মাত্রায় জোলাপ জাতীয় ওষুধ খাওয়া- এর ফলে জল এবং সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও অন্যান্য ইলেক্ট্রোলাইট্স-এর অভাব সৃষ্টি হয় আর মাংশপেশিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। বেশি মাত্রায় এনিমা নিলে অস্ত্র ও শরীরের ক্ষতি হয়।
(৩) মলান্ত্রিক উদ্বায়ু রোগ (Colonic neurosis)- এই বিকারটি প্রধানত বাচ্ছাদের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের পর দেখা দেয়। বাচ্ছাদের খুব বেশি শাসন করলে তারা উদ্বিগ্নতায় ভুগে থাকে। অনেক সময় বাচ্ছা যদি সকাল সকাল পায়খানা না করে তাহলে তার পেটপরিষ্কার করতে জোলাপ জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় যার দরুন সে ক্রমে ওষুধটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। P/R বা মলদ্বারে আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করলে শক্ত মল জমাট বাঁধা অবস্থায় অনুভূত হয়।
রোগ নির্ণয়:-
১. রোগীর খাওয়া-দাওয়া সংক্রান্ত অভ্যাসের খুঁটিনাটি জানতে হবে।
২. কোনো রোগ থাকলে, অপারেশন হয়ে থাকলে বা রোগীর ওষুধ সেবন সম্পর্কে জানতে হবে।
৩. তারপর-Proctoscopy বা মলাশয় বীক্ষণ পরীক্ষা
৪ .মলদ্বারে আঙুল প্রবিষ্ট করে পরীক্ষা (P/R) |
৫. সিগমান্ত্র পরীক্ষা (Sigmoidoscopy)
৬. বেরিয়াম এনিমা (Barium enema) প্রভৃতি পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা হয়। এই রোগের প্রধান কারণ বা কারণগুলি সম্পর্কে জানতে হবে। এই সব পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে অর্শ, ভগন্দর ও ক্যানসার প্রভৃতি সম্পর্কে জানা যায়।
জটিলতা (Complications):-
১. বার বার বেগ দিয়ে পায়খানা করতে থাকলে অর্শ, ভগন্দর, গুদভ্রংশ (Rectal prolase) প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।
২. বেগ দিয়ে জোর করে পায়খানা করতে থাকলে কুঁচকিগত হার্নিয়া (Inguinal hernia) হতে পারে।
৩. বেগ দিয়ে পায়খানা করার দরুন হাৎপেশীয় কলাবিনষ্টির (Myocardial infarction) প্রকোপ বাড়তে পারে।
৪. মলান্ত (Colon) শক্ত হয়ে পাইপের মতো হয়ে যেতে পারে।
চিকিৎসা:-
যতদূর সম্ভব প্রাকৃতিক ভাবে নিরাময়ের জন্য চেষ্টা করতে হবে। পেট পরিষ্কার করার ওষুধপত্র, এনিমা প্রভৃতির অভ্যাস না করানোই ভাল।
(১) তরল পদার্থের সেবন-তরলের পদার্থের বা জলের সেবন কম হলে দেহে জলাভাব দেখা দেয়। জলাভাব দেখা দিলে অবশিষ্ট জল খাদ্য হজম করতে বা বৃহদান্ত্রে শোষিত হয়ে নিঃশেষিত হয়ে আসে যার দরুন মল শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। তাই একজন সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে দৈনিক ১০ থেকে ১২ গেলাস জল খাওয়া বাঞ্ছনীয়।
(২) খাদ্যাভ্যাস-রোগীকে পর্যাপ্ত মাত্রায় আঁশযুক্ত খাদ্যদ্রব্য (যেমন তাজা সবুজ শাক-সব্জি, গাজর, মুলো, টম্যাটো, ফল, স্যালাড প্রভৃতি) খেতে হবে। এই সব খাদ্য হজমশক্তি ঠিক রাখতে সাহায্য করে। আঁশ বা সেল্যুলোজযুক্ত খাদ্যদ্রব্য অন্ত্রের ক্রমসংকোচ (Peristalsis) বাড়িয়ে দেয়। রোগীকে ভূষিযুক্ত আটার রুটি খেতে হবে। তেল মশলাযুক্ত গরিষ্ঠ খাদ্য খাওয়া একেবারে বন্ধ করতে হবে। ভূষিযুক্ত আটার রুটি, মৌসমী সব্জি, ফল প্রভৃতি পেট পরিষ্কার রাখে।
(৩) ব্যায়াম-নিয়মিতভাবে ব্যায়াম করলে অস্ত্রের ক্রমসঙ্কোচ ঠিক থাকে, খাবার ভালভাবে হজম হয়। পেটের মালিশ করাও রোগীর পক্ষে ভাল।
(৪) জলাকর্ষী কলোয়েন্স (Hydrophilic Colloids)- এই জাতীয় পদার্থ অস্ত্রে জল শোষণ করে ফুলে ওঠে আর অস্ত্রে চাপ সৃষ্টি করে ক্রমসঙ্কোচ বাড়িয়ে দেয়। এরসঙ্গে যথেষ্ট মাত্রায় জলও খেতে হবে। ইসবগুলের ভুসি একটি ভাল জলাকর্ষী কলোয়েড হিসাবে কাজ করে থাকে।
ঔষধোপচার :-
(১) মল শক্ত ও কম পরিমাণে হলে Agarol syrup বা Cremaffin syrup দেওয়া হয়।
(২) মল কম পরিমাণে হলে Bulk forming preparation যেমন Fibrebran. সাইলিয়াম, ইসবগুলের ভুসি ও মিথাইল স্যালুলোজ প্রভৃতি। এগুলি খাওয়ার পর এক গেলাস হালকা গরম দুধ খাওয়া ভাল।
(৩) মল বেশি শক্ত হলে Glycerin Suppository মলদ্বারে ও মলনালিতে লাগিয়ে দিলে ভাল হয়। এতে কাজ না হলে এনিমা দিতে হয়। আজকাল বাজারে 'তৈরি এনিমা' পাওয়া যায়। মলত্যাগ করানোর জন্য এনিমা দেওয়া হয়ে থাকে। এনিমার জন্য একটি এনামেলের ডুশ ক্যান ও একটি রবার বা প্লাস্টিকের নলের দরকার হয়। এনামেলের পাত্রের পেছনের দিক সমতল এবং দেওয়ালে টাঙ্গাবার জন্য একটি আংটা আর সামনের অংশের নীচের দিকে একটি ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্রে রবারের নল লাগানো হয়। রবারের নলটির অন্য প্রান্তে একটি স্টপ্ কক্-যুক্ত নজল থাকে। এনিমা দেওয়ার আগে রোগীর পাছার নীচে বালিশ দিয়ে তাকে একটু উঁচু করতে হবে। রবারের নলের nozzle-এ একটু ভেসলিন লাগিয়ে সেটি আস্তে আস্তে মলদ্বারের মধ্যে ঢুকিয়ে স্টপকটি অল্প খুলে দিতে হয়। তাছাড়া 'তৈরি এনিমা' Rectal Syringe-এর সাহায্যেও মলনালিতে প্রবিষ্ট করা যায়। তৈরি এনিমার বাণিজ্যিক নাম Practo-Clyss enema, Dulcolox প্রভৃত্তি।
(৪) কোষ্ঠকাঠিন্যে ব্যবহৃত অন্যান্য ওষুধগুলি হল-
১. Docusates.
২.Laxicon,
৩.Bisacodyl,
৪.Senna,
৫. Cascara,
৬.Lactulose, Plant Mucus of the Bassorin Series, Castoroil (এটি অর্শে আক্রান্ত রোগীদের দেওয়া যাবে না) প্রভৃতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন